
সকাল
‘করুণা –‘
রবিবারের সকাল। চারিদিকে একটা ছুটির আমেজ। কাঁচা শরতের আকাশ ঝলমল করছে। সকালের মৃদু আলো মাখামাখি হয়ে আছে ‘সুখনীড়’ আবাসনের ফ্ল্যাটগুলোয়। দু’চারটে কাগ চারতলার মাথায় প্রাণপণে ডেকে চলেছে।
‘করুণারে –‘
‘আঃ। সকালবেলা যে কাগজটা শান্তিতে পড়বো তারও উপায় নেই। কী হলটা কী?’
‘আমায় ঐ নিচেটায় একটু বসিয়ে দিবি?’
‘কেন, এখানটা কী অসুবিধা করলো? সাতসকালে ঐ খোলা জায়াগায় না বসলেই নয়? আর এত সকাল সকাল ওঠারই বা দরকার কি তোমার? একটু বেলা অবধি ঘুমোলেই তো পারো।’
‘এত সকাল কি রে? সাতটা বেজে গেছে কখন।
ভেতর থেকে আর একটা সরু গলা ভেসে এল। ‘- কিগো, বাজারের কথা মাথায় আছে? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বকলে মাছটা পাবে?’
কাগগুলো ডেকেই চলেছে। বেলা যত বাড়বে আস্তে আস্তে ওদের ডাকগুলো অস্পষ্ট হতে হতে হারিয়ে যাবে। আরো শব্দ জন্ম নেবে ক্রমশঃ। প্রথমে সাইকেলের বেল, ধীরে ধীরে বাস, ট্যাক্সি, মানুষের পায়ের শব্দ, বিভিন্ন রকমের হর্ন। তারপর সারাদিন পাশের সিঁড়িটায় নানাধরণের জুতোর শব্দ।
বাজারের থলেটা নিয়ে বেরিয়ে গেল করুণাময়। স্নেহময় চ্যাটার্জির তৃতীয় সন্তান। একটা বেসরকারি কোম্প্যানিতে কাজ করে। বড় ছেলে আনন্দময় ফরেনার। কানাডায় আছে বছর দু’য়েক। এক মেয়ে আছে। অবিশ্যি বিয়ে হয়ে গেছে বছর পাঁচেক হল। করুণাময়ই সর্বকনিষ্ঠ। ‘সুখনীড়’ আবাসনের এই নিচের তলার ফ্ল্যাটটায় ওঁরা এসেছেন বহুদিন হল। এখান থেকেই বিয়ে হয়েছে স্নেহময়বাবুর মেয়ের। এখন থাকে ছোট ছেলে, বৌমা আর স্নেহময়বাবু। সংক্ষেপে এই হল স্নেহময়বাবুর সংসার।
‘বৌমা –‘
একবার ডেকেই ইদানিংকালে সাড়া পেয়েছেন বলে মনে পড়ে না তার। তবু ডেকে ফেলেন, কখনো সখনো অচেতনেই দ্বিতীয়বার।
‘বৌমা –‘
‘কী বলছেন?’ আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বারান্দায় আসে মালতি।
‘একটু ধরতো মা, ঐ নিচেটায় একটু বসি।’
‘ওঃ বাবা, আপনি আজকাল বড্ড ছটফট করেন। গেটের সামনে বসে তো যত রাজ্যের মাছঅলা আর দুধঅলার সংগে গল্প করবেন। আপনার ছেলে এসব পছন্দ করে না।’
‘আচ্ছা, থাক্ তবে। আজ দশ তারিখ না বৌমা?’
‘হুঁ’
‘আমায় এক কাপ –‘ ততক্ষণে ভেতরে চলে গেছে মালতি।
স্নেহময় চ্যাটার্জি। ‘সুখনীড়’ আবাসনের গ্রাউন্ড ফ্লোরের ২৪৫ নং ফ্ল্যাটের বারান্দায় একটা চেয়ারে বসে। কিংবা বলা ভাল একটা চেয়ারে বসানো। গত মার্চের দিকে একটা ম্যাসিভ হার্ট এ্যটাকের পর থেকেই পঙ্গু। দেহের দক্ষিণাংশ সম্পুর্ণ অনুভুতিশুণ্য। হাউসিং-এর শঙ্কর এসে মাসে দু’দিন ফিজিওথেরাপি করে যায়। ব্যস্, ঐ পর্যন্তই। ওঠা হাঁটা কিছুই করতে পারেন না। কাগজটা খুলে বসলেন স্নেহময়বাবু।
কাগজের প্রথমেই খেলার পাতায় চলে যান স্নেহময়বাবু। প্রথম পাতাটা ইদানিং আর পড়েন না। কী হবে ওসব অশান্তির খবর পড়ে? দিনরাত খালি যুদ্ধ, খুন-জখম, শুয়োরের রাজনীতি, আর নাবালিকার শ্লীলতাহানি। মানুষগুলো জন্তু হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন।
কলেজজীবনে তিনিও ক্রিকেট, ফুটবল কম খেলেননি। ফুটবলে রাইট উইঙ্গার, ক্রিকেটে উইকেট কিপার। আজ দীর্ঘশ্বাস পড়ে। কে বলবে এই স্নেহময় চ্যাটার্জি ডিস্ট্রক্ট লেভেলের এ্যথলিট ছিল? এই ডানপা দিয়েই অনায়াসে পঞ্চাশবার বল নাচাতো?
সেদিনের সেই ছেলেটাকে মনে পড়ে। তরতাজা প্রাণবন্ত যুবক। পাক্কা স্পোর্টসম্যানের চেহারা। দাপিয়ে বেড়াতেন স্কুল, কলেজ, মাঠ। বাবার কাছে কম বকুনি খেয়েছেন? এক এক সময় এক একটা ঝোঁক চাপত মাথায়। একবার তো নিজে নিজে সাঁতার শিখতে গিয়ে মরতেই বসেছিলেন।
আজ ১০ই সেপ্টেম্বর। আজ যেন বড় একা মনে হচ্ছে নিজেকে। আজ যদি প্রতিমা পাশে থাকতো। হঠাৎ করে চোখে জল এল স্নেহময়ের। কাগজটা সরিয়ে রাখলেন পাশে। ঘাড়টা এলিয়ে দিলেন ব্যাকরেস্টে। আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস মেশানো হাসি ফুটলো মুখে।
প্রতিবার এই দিনে সক্কালবেলা একগোছা রজনিগন্ধা গুঁজে দিত টেবিলের ফুলদানিটায়। আর তারপর — দরজাটা ভেজিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে …………..। করুণা বড় হয়ে যাওয়ার পরেও। কি ছেলেমানুষ ছিল! শেষ বছর ও কম্মোটি তিনিই করেছিলেন। ও তখন বিছানায় শয্যাশায়ী। বাহাত্তর বছর বয়সে স্ত্রীকে ওই উপহারটুকু দিয়ে বিছানায় মিশে যাওয়া কঙ্কালসার বুকে মাথা রেখে শুয়েছিলেন কিছুক্ষণ। আপনমনে হাসতে হাসতে চোখদুটো মুছলেন স্নেহময়। এই প্রথম ১০ই সেপ্টেম্বর উনি একা।
দুপুরের খাওয়ায় মৌরলা মাছ ছিলো স্পেশাল। সরষেবাটা দিয়ে ঝাল। স্নেহময়ের দারুণ প্রিয় পদ। ছোটবেলায় মা করে দিত। মায়ের কাছ থেকে প্রতিমা শিখে নিয়েছিলো ওই পদখানার খুঁটিনাটি। তবে পায়েসটা কোনদিনই মা’য়ের মত পারেনি প্রতিমা। সেজন্য কম রাগাতেন ওকে স্নেহময়।
অতীত, সমস্ত অতীত। আজ তিয়াত্তর আর চুয়াত্তরের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে পঙ্গু স্নেহময় চ্যাটার্জিকে দেখে স্বাভাবিকভাবেই মনে হয় তিনি মোটামুটি সুখেই আছেন। মেয়েকে ভালভাবে পাত্রস্থ করেছেন। দুই ছেলেই প্রতিষ্ঠিত। সংসারের সমস্ত কর্তব্য মোটামুটি সম্পন্ন হয়েছে। তার কাজ শেষ।
এরা বোধহয় ভুলেই গেছে আজ ১০ই সেপ্টেম্বর। আর যাবে নাই বা কেন? একজন অপ্রয়োজনীয় মানুষের আবেগ নিয়ে কে আর কবে মাথা ঘামায়। আবার কাগজটা তুলে নিলেন স্নেহময়। বহুদিন বাদে আবার খুললেন প্রথম পাতাটা। বাঁচার অধিকার মানুষের মৌলিক অধিকার, অথচ মরার অধিকার যে কেন মানুষের নিজস্ব নয়! অথবা এই বয়সে এসে কিছু চাওয়াটাই ভুল। এদের তো কারো ফুল এনে রাখার দায় নেই। ‘সঞ্চয়িতা’টা খুব পড়তে ইচ্ছে করছিলো। চাইতে সাহস করলেন না।
হুড়মুড় করে ঢুকলো করুণাময়। ব্যাগটা ধপ্ করে রেখেই চিৎকার করে উঠলো, ‘তোমার জন্য কি আমি পাগল হয়ে যাবো?’
বিস্মিতভাবে স্নেহময় দেখলেন কথাটা তাকে উদ্দেশ্য করেই বলা হচ্ছে।
মালতি বেরিয়ে এল, ‘আঃ, কী ষাঁড়ের মত চেল্লাচ্ছ? কী হলটা কী?
ব্যাগ থেকে একটা ক্যারিব্যাগ বার করলো করুণাময়। ‘নাও, এবার বাছো বসে বসে। কাল ভোলা বাগদীকে উনি ডেকে বলেছেন আধকিলো কুচোমাছ রেখে দিতে। আমি আজ নিয়ে আসবো। আধকিলো! বাজারে কুচোমাছ ওঠেনি আজ, দেড়া দামে এসব ছাইভস্ম নিতে হল আমায়।’
‘অন্যমাছ এনেছ নাকি?’
স্নেহময় উঁকি দিয়ে দেখলেন মাছের ব্যাগটা। মৌরলাই দিয়েছে ভোলা।
রাগে থমথম করছে করুণাময়ের মুখ। ‘আবার কী আনবো? এগুলোই গেলো বসে। এতেও শান্তি নেই। হোসেন মিস্ত্রির ছেলেকে আবার নেমন্তন্য করা হয়েছে দুপুরে খাওয়ার জন্য। কেন, কী উৎসবটা আছে আজকে শুনি? এইজন্য তোমাকে নিচে বসতে দিইনা। যত আদিখ্যেতা ওই থার্ডক্লাস লোকগুলোর সঙ্গে।
‘ওমা..। হোসেনের ছেলে আবার আসবে নাকি?’
‘পাগল না মাথা খারাপ তোমার? ওসব ফোরটোয়েন্টি ছেলেকে কেউ ঘরে ঢোকায়? বারণ করে দিয়েছি আমি।’
কাগগুলো এখনো ডাকছে। ওরা গজগজ করেই চলেছে। মুণ্ডপাত হচ্ছে স্নেহময়বাবুর। নির্বাক চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে স্নেহময়। এই বারান্দা থেকে আকাশটা ভালো দেখা যায় না। একটা হিমেল বাতাস এসে স্নেহময়ের গায়ে হাত বুলিয়ে গেল। হোসেন মিস্ত্রির ছেলেটাকে বড় ভালোবাসতো প্রতিমা।
Get Curated Photography Update in Your Mailbox
Join our mailing list to get regular photography updates (not more than 5 in a month).
Thank you for subscribing.
Something went wrong.
We respect your privacy and take protecting it seriously