দৃষ্টিভঙ্গি

বির দিকে তাকালেই মনে পড়ে—দৃষ্টিভঙ্গি আসলে দুই রকম। একদিকে সেই মানুষটি যিনি ছবি তোলেন, আর অন্যদিকে যিনি তা দেখেন। এই দুই দৃষ্টিভঙ্গি অনেক সময় একেবারে বিপরীত হয়, তবুও তারা একসঙ্গে জুড়ে যায় এক ফ্রেমে। কখনও দ্বৈত, কখনও পরিপূরক। ঠিক যেন দুই বন্ধু—যারা চিন্তায় ভিন্ন, তবু চলার পথ এক।

সেদিন বর্ষার দিনে ট্রেন ছুটে চলেছে। জানালার কাচে জলরেখা জমে আছে, আর তার আড়াল দিয়ে পিছিয়ে পড়ছে বহুদিনের চেনা দৃশ্য—ধানক্ষেত, কুয়াশায় ভেজা স্টেশন, নদীর কিনারা। বহু বছর পর দিনের বেলা এই পথ, কলকাতা-শিলিগুড়ির ট্রেন পথ, যেন আবার একবার ছুঁয়ে যাওয়া।

কিন্তু এবারের যাত্রা কেবল গন্তব্যের ছিল না। বরং অনেকটা ভিতরের চাপা টানাপোড়েনও বয়ে নিয়ে যাওয়া। প্রিয় মানুষের হঠাৎ অসুস্থতা, কাজের ভেতরে সময় ছিনিয়ে আনা, অনিচ্ছুক নিয়মের ফাঁক গলে—সবকিছু পেরিয়ে শেষমেশ রওনা হওয়া। ছিল ব্যাখ্যার ক্লান্তি, ছিল অদৃশ্য বেড়ি পড়া মনের অসস্তিকর দৃশ্য। তবে এখন যেন পিছিয়ে যাচ্ছে সব। সব মিশে যাচ্ছে এক আশ্চর্য নীরবতা ও ট্রেনের ছন্দে। কিভাবে যেন ছবির ফ্রেমগুলো নিজে থেকেই একটু কাত হয়ে গেল। মনের অদৃশ্য বলে ইচ্ছাকৃতভাবে সরিয়ে নেওয়া চেনা রেখা থেকে। ঠিক যেমন বাস্তবতা কখনও নিজের ছকে না থেকে বদলে যেতে চায়। এই বেঁকে যাওয়া ফ্রেম আসলে কোনও টেকনিক্যাল কৌশল নয়, বরং একটা মানসিক অবস্থার প্রতিফলন। ছবি তোলার ব্যাকরণ —লাইন, স্পেস, আলো, ছায়া, রঙ— মিলিয়ে চলে যাচ্ছে যেন মনের ভাবের দিকে তৈরি করছে এক নিজস্ব ভাষা। আর সেই ভাষাই আজ নিজেকে প্রকাশ করেছে, একটু অন্যভাবে। ছবির মধ্যে সেই অর্থে চেনা দৃশ্য নয়, ধরা পড়েছে মনের প্রতিচ্ছবি। বাইরে যা দেখা যাচ্ছে, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে কেমন করে দেখছি সেটা। যেন প্রতিটি দৃশ্য একটা আয়নার মতো—যেখানে বাইরের রঙের চেয়ে বেশি পড়ে আছে মনের রঙ।

প্রতিটি ছবি যেন প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় —
এই দ্বন্দ্বটা কিসের? পরিস্থিতির সঙ্গে? না নিজের সঙ্গে?
দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেলে ছবির ভাষাও কি বদলে যায়?
একই দৃশ্য কি তখন নতুন মানে পেতে পারে?

ট্রেন চলতে চলতে সেই প্রশ্নগুলো ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে যায়। ট্রেনের তাল যেন মনকেও ছুঁয়ে ফেলে। ভিতরে জমে থাকা সবকিছু একটু একটু করে গলে গিয়ে তৈরি করে এক আত্মসংলাপের রিদম্। শেষমেশ মনে হয়, এই সফরটা শুধু বাইরে যাওয়ার নয়, বরং নিজের ভিতরে ফিরে আসা। আর ছবিগুলো—এই বোঝাপড়ার এক ধরনের বাইরের প্রকাশ।

Get Curated Photography Update in Your Mailbox

Join our mailing list to get regular photography updates (not more than 5 in a month).

Thank you for subscribing.

Something went wrong.

Related Articles

ছবিযাপন – শিল্পীর স্বাধীনতা ও কেন্দ্রিক-বিকেন্দ্রিক পরিচালনা

স্বাধীনতা ব্যপারটা বেশ মজার। সবাই চায়, কিন্তু পায় কে বলা মুশকিল। আবার ঠিকঠাক চায় কে তাও ভারি সন্দেহের বিষয়। কিন্তু হাটের মাঝে কথাটার মধ্যে আনন্দ…

ছবিযাপন । Form (আকৃতি) এবং কিছু চিন্তা

ফোটোগ্রাফি চর্চায় ফর্ম-এর বাংলা আমার মতে ‘আকৃতি’ হওয়া উচিৎ। মূর্তি বললে ভালো হয়, তবে মূর্তি বলতে মানুষ ঠাকুর দেবতা ছাড়া বিশেষ কিছু বোঝে না সাধারণতঃ। তাই আকৃতি বলাই সহজ। তবে মূর্তির ধারনা বাদ দিয়ে আকৃতি বোঝা বিড়ম্বনা। এইখানেই বাঁধে গোলমাল। আমাদের প্রাচ্য সংস্কৃতিতে মূর্তির ধারণা আজীবন হাজার ভাঙা গড়ায় এগিয়েছে। আমাদের অচেতনেই সে বোধ আমাদের মধ্যে গাঁথা। চট করে তা চেতন বোধে আসে না বটে, আসার দরকারও নেই যতক্ষণ না কেউ শিল্পসৃষ্টি করতে চাইছে। কিন্তু ফোটোগ্রাফি যখন ফর্ম-এর ব্যবহার করে তখন তা বেশিরভাগটাই পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গী থেকে। ফলে আমরা, প্রাচ্যদেশীয়রা যখন ফোটোগ্রাফি চর্চা করি তখন একটা খিচুড়ি মার্কা আংশিক বোধ থেকে দেখতে পাই। আমাদের অন্তর্গত বোধ ফর্ম কে একভাবে চেনে, জানে। আর ফোটোগ্রাফিতে আমরা অজান্তেই যতটুকু ফর্ম ব্যবহার করি সে ওদেশের কায়দায়। ব্যাপারটা আরো ভালো করে বুঝতে হলে ফর্ম বা আকৃতির স্বরুপখানা ভালো করে বুঝতে হবে।

ছবিযাপন । Form (আকৃতি) – প্রাচ্য সাংখ্যদর্শনের দৃষ্টিকোন

প্রাচ্যশিল্পভাবনার প্রধান ধর্ম এই মূর্ত এবং বিমূর্তের সম্পর্ক। কেবল শিল্পভাবনা না বলে দর্শনভাবনা বা জীবনভাবনাও বলা যেতে পারে। শিল্প, দর্শন এবং জীবন একই ধারণার ভিন্ন রূপ, ভিন্ন প্রকাশ বই অন্য নয়। বরং বলা যেতে পারে জীবনকে বোঝবার এবং বোঝাবার জন্যই দর্শন এবং শিল্পের প্রয়োজন পড়লো। নইলে শিল্পের অন্যতর কোন দায় নাই। না প্রকাশের অন্য দায় আছে। মূর্ত, বিমূর্ত বা এদের দুইয়ের সম্পর্ক নিয়েই আমাদের দর্শনের যত প্যাঁচপয়জার। আমাদের দর্শনের অন্ততঃ খানিক ধারণা না হলে মূর্ত বিমূর্তের ঘোরপ্যাঁচে আটকে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা আছে। আমাদের দর্শন ধ্রুপদ থেকে লোকায়ত পর্যন্ত এক বিরাট পরিধি জুড়ে ছড়িয়ে আছে। এ দর্শনের গভীর অনুভব এক জীবনে সম্ভব নয়। একক চেষ্টায় সম্ভব নয়। তবে বিন্দুতেও সিন্ধুর আস্বাদ তো মিলতে পারে, খানিক নোনা স্বাদই সই। সেই আশাতেই এইসব বালখিল্য বাচালতা করার সাহস হয়।

ছোটে গোলাম ফকিরের মেলা

” মানুষ বানাইছে আল্লা প্রেমের কারণে ” – রসিদ চাঁদ। আর এই প্রেম আর বিশ্বমানবতার টানেই মুর্শিদের সাথে এবং সর্বোপরি মানুষের সাথে মানুষকে ‘ প্রেমের ডুরি ‘ তে বাঁধতে বসে রসিদ চাঁদের চালিশার মেলা।

Line – Seven Elements Series

ফোটোগ্রাফির একেবারে গোড়ার কথা হল সাত দৃশ্যাঙ্গের কথা। ফোটোগ্রাফিতে ‘কম্পোজিশান’ শব্দটি প্রায় সব্বাই শুনেছেন এবং কিছুদিন ফোটোগ্রাফি চর্চা করলেই ‘কম্পোজিশান’ সম্বন্ধে একটা মোটামুটি ধারণা জন্মায় প্রত্যেকেরই। প্রচলিত ‘কম্পোজিশান’-এর ধারণায় কিছু চিরন্তন পদ্ধতির কথাই বলা হয়ে থাকে বেশিরভাগ আলোচনাতেই। আধুনিক সময়ে দাঁড়িয়ে চিরন্তন পদ্ধতির বাইরে ‘কম্পোজিশান’-কে দেখা দরকার।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
aleek
Member
19 days ago

প্রচলিত ভাবনায় শিল্পকর্ম মানেই বিশাল গভীর, ভয়ানক উচ্চমার্গের ব্যাপার স্যাপার। এর বাইরে অতি সাধারণের মধ্যে যে ব্যক্তিক নিজস্বতার আভরণহীন সৌন্দর্য আছে তা মানুষ ভুলে যায়। তুমি সেই অতি সাধারণ সুরখানা ধরার চেষ্টা করেছো। এইই বড়ো আনন্দের।

এ কাজ করতে সাহস লাগে। নিজের সঙ্গে কথা বলার সাহস, সেই কথোপকথন নগ্নভাবে বিশ্বের সামনে রাখার সাহস।

অতি সাধারণের মধ্যে আলৌকিক অসামান্যের আলো আরো পরিস্ফুট হয়ে উঠুক তোমার দর্শনে…🌿